শকুন
জুলিও রামোন রিবেইরো
অনুবাদ- বর্ণালী জানা
সকাল ছটা। শীতের মিহি কুয়াশার ওড়না সরিয়ে আড়মোড়া ভাঙছে শহরের। কুয়াশায় ঢাকা শহরটাকে দেখতে কেমন যেন অপার্থিব…ভূতুড়ে লাগে।ধর্মপ্রাণ মহিলারা দল বেঁধে চলেছে গির্জার দিকে। রাতের ভবঘুরেরা অন্ধকার গায়ে মেখে বিষণ্ণ মুখে বাড়ির পথ ধরেছে। পেদ্রো অ্যাভিনিউতে কাগজকুড়ুনিদের ভিড়। হাতে তাদের ঝাঁটা, বালতি। কলকারখানার শ্রমিকরা হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটছে গাড়ি ধরার জন্য। কাগজওয়ালারা ঠান্ডায় জমে নীল। বাড়ির কাজের মেয়েরা বালতিভর্তি যত জঞ্জাল রেখে যাচ্ছে রাস্তার ধারে। স্যানিটারি বিভাগের গাড়ি এসে ওগুলো নিয়ে যাবে। ঠিক এই সময়ই শহরে জুটে যায় যত রাজ্যের শকুন…তাদের গায়ে কোন পালক নেই…একেবারে কুচ্ছিত, কদাকার।
এই ব্রাহ্ম মুহূর্তেই প্রতিদিন ঘুম ভাঙে ডন সান্তোসের। কাঠের পা-টা ভালো করে বেঁধে ষাড়ের মতো তর্জন-গর্জন শুরু করে দেয়… ‘এই হতচ্ছাড়া এফ্রিন…এনরিকে…জলদি ওঠ!’
চোখ কচলাতে কচলাতে দুই ভাই ছোটে কোরালের* পাশের ডোবায়। ঠান্ডায় ডোবার জল জমে বরফ। কাচের মতো বরফের নীচে আগাছাগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। মুখ-হাত ধুয়ে দুই ভাই টিন নিয়ে ছুট লাগায় রাস্তায়। আর এদিকে ডন সান্তোস ঢোকে খোঁয়াড়ে। শুয়োরটাকে ময়লা খেতে দেখে বুড়ো মারে এক লাঠির বাড়ি… ‘রাস্কেল কোথাকার! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন’!
ওদিকে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে দুই ভাই। গাছে উঠে কুল পেড়ে খায়। গাছে উঠতে না পারলে নীচ থেকে পাথর ছুঁড়ে কুল পাড়ে। খুঁজে খুঁজে যত ছূঁচলো পাথর ওদের বের করা চাই। তা দিয়ে লক্ষ্যভেদ হয় অনেক ভালো। ভোরের এই অপার্থিব মুহূর্তকে সাক্ষী রেখে ওরা ছুটে যায় ঐ রাস্তার দিকে। ঐ রাস্তাটা সোজা খাঁড়ির দিকে চলে গেছে। রাস্তার ধারে সার দিয়ে সুদৃশ্য সব বাড়ি।
এ রাস্তায় ওরা একা নয়। ওদের মতো আরো অনেকে আছে। অন্য শহরতলির কোরালগুলোতে ওরা থাকে। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও রাস্তায় জুটে যায়। কারো হাতে বালতি, টিন, আবার কারও হাতে কার্ডবোর্ডের বাক্স, কখনও বা শুধুই পুরোনো একটা খবরের কাগজ। ওরা কাউকে চেনে না…মনে হয় শহরের কোন গুপ্ত সংগঠনে নাম লিখিয়েছে…গোপনে, লুকিয়ে-চুরিয়ে যে যার মতো কাজ হাসিল করে যায়। কেউ কেউ বড় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে…কেউবা পার্কে…আবার কেউ ময়লার গাদার সামনে। খেতে না পাওয়া দড়ি পাকানো কুকুরগুলোও এসে জোটে।
একটু বিশ্রাম নিয়েই কাজে নেমে পড়ে এফ্রিন আর এনরিকে। রাস্তার এক এক ধারে একেক জনের কাজ । বড় বড় বাড়িগুলোর দরজার সামনে ময়লার ঝুড়ি। ময়লার ঝুড়ি উপুড় করে তারা হাতড়ে হাতড়ে খোঁজে অমূল্য রতন। তা মিলেও যায়…সার্ডিনের টিন, পুরোনো জুতো, পাউরুটির টুকরো, মরা টিয়াপাখি, নোংরা তুলো। এফ্রিন আর এনরিকে শুধু ফেলে দেওয়া খাবার-দাবার খুঁজে বেড়ায়। পাস্কুয়ালের খিদে মেটাতে হবে যে! পাস্কুয়াল যা পায় তার ওপরই হামলে পড়ে। তবে আধ পচা শাক-সবজিই ওর বেশি পছন্দের। পচা টমেটো, চর্বি, আর দারুন দারুণ সব সালসা মিলে যায় ময়লার গাদায়…রান্নার বইতেও এমন সালসার কথা লেখা থাকে না। এই দিয়েই নিজেদের টিন ভর্তি করে দুই ভাই। ভাগ্য ভালো থাকলে কোন কোন দিন অনেক মহার্ঘ জিনিসও তারা পেয়ে যায়। এফ্রিন একদিন ময়লার ঝুড়িতে প্যান্টের একটা বকলস পেয়েছিল। সেটা দিয়ে একটা গুলতি বানিয়েছিল। একদিন একটা আস্ত আপেল পেয়ে এফ্রিনের আনন্দ আর ধরে না। খাবার-দাবারে অতটা আগ্রহ নেই এনরিকের। ওষুধের বাক্স, রঙিন বোতল, ফেলে দেওয়া টুথব্রাশ…এগুলোর দিকেই তার নজর।
আঁতিপাতি করে ময়লা হাতড়ানোর পর জঞ্জালগুলো আবার ঝুড়িতে রেখে এবার তারা যায় অন্য বাড়ি। রাস্তায় শত্রুরা সবসময় ওঁত পেতে থাকে। মাঝে মাঝে বাড়ির কাজের মেয়েগুলো তাদের হাতেনাতে ধরে টিন কেড়ে নেয়। মাঝে মাঝে যমদূতের মতো আসে স্যানিটারি ডিপার্টমেন্টের লোক। তাদের এত পরিশ্রম সব মাটি!
আস্তে আস্তে সূর্যটা মাথার ওপরে ওঠে। সকাল গড়ায়। চড়া রোদে কুয়াশার চাদরটা কোথায় যে মিলিয়ে যায়! প্রার্থনা সেরে গির্জা থেকে কলকল করে বেরিয়ে আসে মহিলারা। রাতের ভবঘুরেররা এখন গভীর ঘুমে। বাড়ি বাড়ি কাগজ বিলি করে ফিরে যায় কাগজওয়ালারা। আরেকটা অপার্থিব ভোর শেষ হয়। পালক ওঠা, ন্যাড়া শকুনদুটো বাসায় ফেরে।
এদিকে কফি বানিয়ে নাতিদের ফেরার অপেক্ষা করে ডন সান্তোস। নাতিরা ফিরলেই আবার শুরু হয় আরেক প্রস্থ তর্জন-গর্জন… ‘কফিটা গিলে আমায় ধন্য করো। হতচ্ছাড়ার দল আজ কী এনেছিস দেখি’?
লোলুপ দৃষ্টিতে টিনগুলো হাতড়ায় বুড়ো। যেদিন টিন উপচে পড়ে সেদিন বুড়ো মহাখুশি… ‘আজ মনে হচ্ছে পাস্কুয়ালের ভোজটা ভালোই জমবে। তবে বেশিরভাগ দিনই বুড়োর মেজাজ সপ্তমে চড়ে থাকে… “টিন খালি কেনরে হতভাগা। আজ নিশ্চয়ই কোন কাজ করিসনি…খালি আড্ডা দিয়ে বেড়িয়েছিস! ছোটলোক! পাস্কুয়াল কি তবে না খেয়ে মরবে?’
দুইভাই ছুটে আঙুর খেতের দিকে চলে যায়। দাদুর থাপ্পড়ের চোটে কানদুটো এখন ঝাঁ ঝাঁ করছে। ওদিকে পা টেনে টেনে বুড়ো যায় খোঁয়াড়ের দিকে। বুড়োর হাতে খাবার দেখেই শুয়োরটা ঘোঁতঘোঁত করে ছুটে আসে… ‘বেচারা পাস্কুয়াল। আজ তোর ভাগ্যে বিশেষ কিছু জুটবে নারে? ছোঁড়াগুলো আজ কিছুই আনেনি। ওরা তো তোকে আমার মতো ভালবাসেনা! সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না…আচ্ছা করে কড়কে দিতে হবে ওদের’।
শীতের শুরুতেই দৈত্যের মতো চেহারা হয়ে গেল শুয়োরটার। সঙ্গে রাক্ষুসে খিদে। ভালমতো খাবার না পেলেই শুরু হয়ে যায় তার দাপাদাপি। বুড়োর সব রাগ গিয়ে পড়ে নাতিদের ওপর। বুড়ো ভোর বেলা তাদের তুলে দিয়ে বলে ‘এবার অন্য জায়গায় যা…যেখানে কেউ যায় না…একদম সমুদ্রের ধারে চলে যা। ওখানেই তো সব ময়লা ফেলা হয়। অনেক কিছু জুটে যাবে ওখানে’।
এক রবিবার দুই ভাই হাজির হয় সমুদ্রের ধারে। স্যানিটেশন ডিপার্টমেন্টের লোকরা ঠেলাগাড়ি ভর্তি করে জঞ্জাল ফেলে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখে মনে ছোট একটা পাহাড়…যতসব কুকুর আর শকুনের মেলা বসেছে সেখানে। দূর থেকে পাথর ছুঁড়ে ওগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করে দুই ভাই। ওরা যে তাদের গ্রাসে ভাগ বসাচ্ছে। ঢিলের বাড়ি খেয়ে কঁকিয়ে ওঠে একটা কুকুর। ময়লার গাদার কাছে এসে দুর্গন্ধে নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত গুলিয়ে ওঠে দুই ভাইয়ের। শকুনের পালক, বিষ্ঠা আর নোংরায় পা ডুবে যায়। সেদিকে খেয়াল করার সমাই নেই তাদের…ময়লার গাদার হাত ডুবিয়ে তন্ন তন্ন করে চলে তাদের খোঁজ। ভাগ্য ভালো থাকলে হলদেটে কাগজে মোড়া আধখাওয়া মাংশ উঠে আসে হাতে। ওদিকের আরেকটা ময়লার ঢিবিতে বসে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শকুনগুলো । কেউ কেউ আবার এ পাথর থেকে ও পাথরে লাফিয়ে ছেলেরগুলোর হাত থেকে খাবার কেড়ে নিতে যায়। ওদের ভয় দেখাতে চেঁচিয়ে ওঠে এফ্রিন…তার চিৎকার খাদের মধ্যে ধাক্কা খেয়ে ফেরে… দু-একটা পাথর গড়িয়ে পড়ে সমুদ্রে। টিন ভর্তি করে দু ভাই ফিরে আসে কোরালে।
ডন সান্তোসের হাসি আর ধরে না… ‘সাবাশ বেটা…এবার হপ্তায় দু-তিন যেতে হবে ওখানে’।
এবার থেকে রবি আর বুধবার করে চলে যায় তাদের রত্নখনিতে। সমুদ্রের ধারে যত পশু-পাখি আর শকুন থাকে তাদের সব চিনে ফেলে দুই ভাই। শকুনগুলোও এখন দুই ভাইকে দেখে তেড়ে আসে না। এখন তাদের মধ্যে বেশ ভাব। ছেলেগুলোর পাশাপাশি বসেই নোংরা ঘাঁটে তারা। শুধু কি তাই? নিজেদের হলুদ ঠোঁট দিয়ে ময়লা খুঁটে খুঁটে ছেলে্গুলোর পরিশ্রম অনেক কমিয়ে দেয়।
এই বিরাট অভিযান সেরে একদিন বাড়ি ফেরার পর এফ্রিন দেখে পায়ের তলায় একটা ঘা-মতো হয়েছে। কাচের একটা টুকরো ফুটেছে। পরেরদিন সকালে পা ফুলে ঢোল। সেই নিয়েই কাজে যায়। বাড়ি ফেরার সময় সে আর কিছুতেই হাঁটতে পারে না। বাড়ি ফিরে দেখে দাদুর সঙ্গে হোঁৎকা মতো এক লোক দেখা করতে এসেছে। লোকটার হাতে রক্ত। দাদু লোকটাকে নিয়ে গেছে খোঁয়াড়ে… ‘ডন সান্তোস…আমি কুড়ি…তিরিশ দিন পরে আসব। ততদিনে ওটা নিশ্চয়ই আরো নাদুস-নুদুস হয়ে যাবে’।
লোকটা চলে যেতেই দুই ভাই দেখে দাদুর চোখ চকচক করছে। ঘরে ঢুকেই দুজনকে আবার তাড়া দেয় দাদু… ‘এই যে নবাব পুত্তুরেরা, বসে থাকলে চলবে না। কাজে যা। এখন থেকে পাস্কুয়ালকে আরো বেশি করে খাবার দিতে হবে। এই সুযোগটা হারালে চলবে না’।
পরের দিন পরে দুই নাতিকে ডেকে দেয় ডন সান্তোস। ফোলা পা নিয়ে এফ্রিন কিছুতেই উঠতে পারে না।
ভাইয়ের হয়ে মুখ খোলে এনরিকে… ‘ওর পায়ে ব্যথা। হাঁটতে পারবে না। পায়ে কাচ ফুটেছে’।
নাতির পা-টা দেখে শিউরে ওঠে ডন সান্তোস। এ যে গভীর ক্ষত! কিন্তু মুখে বলে ঠিক অন্য কথা… ‘কিচ্ছু হয়নি। সামান্য একটু কেটেছে তার জন্য এত কুলোপানা চক্কর! যা দিয়ে ডোবায় পা ধুয়ে একটা ন্যাকড়া জড়িয়ে নে’।
এবারও ভাইকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে এনরিকে… ‘ওর পায়ে যে ভীষণ ব্যথা। ও হাঁটতে পারছে না’।
চুপ করে এক মুহূর্ত ভাবে দাদু। তারপর খোঁয়াড়ে পাস্কুয়ালের গর্জন শুনে আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না… ‘তাহলে আমার কী হবে? আমার এই কাঠের পায়ে ব্যথা লাগে না? সত্তর বছর বয়স হয়ে গেল এখনও গাধার মতো খাটছি…একদম ঘ্যানঘ্যান করবিনা বলছি’।
দাদুর মুখঝামটা শুনে টিনটা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে রাস্তায় বেরোয় এফ্রিন। পা যেন আর চলে না! ভাইয়ের কাঁধে ভর দিয়ে সে কোনোমতে খুঁড়িয়ে হাঁটে। আর না পেরে আধ ঘণ্টা পরেই দু-ভাই ফিরে আসেনি। টিন প্রায় খালি।
‘দাদু, এফ্রিন পা-একদম গেছে। ও দাঁড়াতেই পারছে না’।
আগুন চোখে নাতিদের দিকে তাকায় ডন সান্তোস…পারলে এক্ষুনি ওদের ভস্ম করে দেবে।
‘বটে?’ পাতলা দাড়িতে একটু হাত বুলিয়ে এফ্রিনের ঘেঁটিটা ধরে ঘরের মধ্যে ধাক্কা মেরে সে ফেলে দেয়… ‘যা বিছানায় শুয়ে শুয়ে মরগে যা। ওখানেই পচে মর। এনরিকে, তোকে ভাইয়ের সব কাজ করতে হবে। এবার আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা’।
দুপুরের দিকে টিন ভর্তি করে কোরালে ফেরে এনরিকে। তার পেছন পেছন নতুন এক অতিথি এসেছে বাড়িতে…ঐ রাস্তার ঘেয়ো একটা নেড়ি কুত্তা। সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করে এনরিকে… ‘এটাকে আস্তাকুড়ে পেয়েছি। সেই যে আমার পিছু নিয়েছে আর ছাড়ছেই না!’
লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে ডন সান্তোস… ‘তা ঐ ব্যাটাকে কে খাওয়াবে?’
এনরিকে ছুটে এসে কুকুরটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে… ‘দাদু ওকে মেরো না। আমি আমার খাবার থেকেই ওকে ভাগ দেব’।
ডন সান্তোস আবার তেড়ে আসে নাতির দিকে…কাঠের পা-টা তার কাদায় দেবে যায়… ‘এখানে কোনও কুকুরের থাকা হবে না। একা রামে রক্ষে নেই আবার সুগ্রিব দোসর!’
দরজাটা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে যেতে চায় এনরিকে… ‘ও না থাকলে এ বাড়িতে আমিও থাকব না’।
একটু দমে যায় ডন সান্তোস। এই সেদিনের ছোঁড়াও তবে ঝোপ বুঝে কোপ মারছে! ওকে ছাড়া তো এখন কোনও গতিও নেই। এনরিকে জেদ ধরে বসেই থাকে… ‘ও তেমন কিছু খায় না দাদু। কেমন হাড় জিরজিরে চেহারা তো দেখতেই পাচ্ছ। এফ্রিন এখন বেরোতে পারছে না। কুকুরটা থাকলে আমার কাজে অনেক সুবিধা হবে। ও আস্তাকুড়গুলো খুব ভালো চেনে। ও শুঁকেই বলে দেবে কোথায় কী আছে’।
হাল ছেড়ে দিয়ে ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে ডন সান্তোস। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। কোন কথা না বলে টিনটা নিয়ে খোঁয়াড়ের দিকে হাঁটা দেয়। দাদুকে হারতে দেখে আনন্দে কুকুরটাকে বুকে জড়িয়ে ভাইয়ের কাছে ছুটে যায় এনরিকে।
ওদিকে খোঁয়াড় থেকে ভেসে আসে দাদুর গর্জন… ‘পাস্কুয়াল…পাস্কুয়াল…পাস্কুয়ালিতো।
কুকুরটাকে ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দেয় এনরিকে… ‘বুঝলি ভাই, এটার নাম দেব পেদ্রো’। ভাইয়ের অবস্থা দেখে মুখটা তার শুকিয়ে যায়। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে এফ্রিন। ঘামে জবজব করছে সারা শরীর। পা-টা এই গোদা হয়ে ফুলে রয়েছে। আঙুলগুলো যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে… ‘ভাই তোর জন্য এটাকে এনেছি। পেদ্রো এখন থেকে তোর সঙ্গেই থাকবে। আমি যখন কাজে যাব তখন তুই ওর সঙ্গে খেলতে পারবি। ও তোকে পাথর কুড়িয়ে এনে দেবে’।
‘আর দাদু? দাদু তো মেরে শেষ করে দেবে তোকে’।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে এনরিকে… ‘নাহ, দাদু কিছু বলবে না’।
দরজার বাইরে তাকায় দুইভাই। বৃষ্টি পড়েই চলছে। খোঁয়াড় থেকে শোনা যাচ্ছে দাদুর কাতর ডাক… ‘পাস্কুয়াল…পাস্কুয়াল…পাস্কুয়ালিতো’।
আজ পূর্ণিমা। এ কথা মনে করেই ভয়ে কাঠ হয়ে যায় ছেলেগুলো। পূর্নিমার রাতগুলোকে দাদুকে সামলে রাখা যায় না। আজ বিকেল থেকেই সারা কোরাল জুড়ে দাদু উন্মত্তের মতো চক্কর কেটে চলেছে। নিজের মনেই কী যেন বিড়বিড়িয়ে বলছে। মাঝে মাঝে লাঠিটা নিয়ে আঙুর লতার ওপর দুম দুম করে ঘা মারছে। মাঝে মাঝেই দরজায় উঁকিয়ে দিয়ে ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া নাতি দুটোকে দেখে ঘেন্নায় থুতু ছেটায়। পেদ্রোও ভয়ে গুটিসুটি মেরে যায়।
চাঁদের দিকে চেয়ে সারা রাত চেঁচিয়ে যায় বুড়ো… ‘রাবিশ, রাবিশ…সব রাবিশ’!
পরের দিন সকালে কাঁপতে কাঁপতে ওঠে এনরিকে। সারা রাত ধরেছে ছেলেটা কেশেছে। দাদু সব শুনেও রা কাড়েনি। ভেতরে ভেতরে প্রমাদ গুনেছে বুড়ো। এনরিকে শয্যা নিলে পাস্কুয়ালের কী হবে? গায়ে যত চর্বি জমছে তত যেন হিংস্র হয়ে উঠছে জানোয়ারটা। তার এখন সর্বগ্রাসী খিদে। আজ সারা বিকেল ধরে কাদায় নাক ঘসতে ঘসতে গর্জন করে গেছে। এ নিয়ে পাশের বাড়ির নেমেসিও পর্যন্ত এসে নালিশ জানিয়ে গেছে।
যে ভয়টা বুড়ো পাচ্ছিল সেটাই সত্যি হল পরের দিন। এনরিকে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। রাত রাত ধরে হি হি করে কেঁপেছে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
‘এবার তুই-ও’? পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায় বুড়োর।
এনরিকে নিজের বুকটা দেখিয়ে দেয়। সর্দি জমে একেবারে ঘড় ঘড় করছে। বুড়ো ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আবার পাঁচ মিনিট পরে ফিরে আসে… ‘সব তোদের শয়তানি! আমি কি বুঝি না? আমি হাঁটতে পারিনা…তাই তোরা সবাই মিলে আমাকে হেনস্থা করছিস। আমার সামর্থ্য থাকলে তোদের দুটোকে দূর করে নিজেই পাস্কুয়ালের দেখাশোনা করতাম’।
এফ্রিন যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে। এনরিকে কাশতে কাশতে হাঁপিয়ে ওঠে’।
‘জাহান্নামে যা তোরা। আমি নিজেই পাস্কুয়ালের দেখভাল করব। সব অপগোণ্ড…ভাগাড়ের শকুন কোথাকার! দেখ এবার আমি কী করি! এ বুড়ো হাড়ে এখনও অনেক জোর রয়েছে। তবে একটা কথা জেনে রাখ আজ তোদের খাওয়া বন্ধ…যতদিন না কাজে যাবি যতদিন উপোস দিয়ে মরবি’।
বুড়ো টলতে টলতে টিনটা নিয়ে রাস্তায় নামে। আধ ঘণ্টা পর বুড়ো খালি হাতে বাড়ি ফেরে। নাতিদের মতো সে ছুটতে পারে না। সে যাওয়ার আগেই স্যানিটেশনের লোকজনেরা সব ময়লা সাফা করে দিয়ে গেছে। তারপর রাস্তার এক খেঁকি কুত্তা তাকে কামড়াতেও গিয়েছিল।
‘নরকের কীট! যতদিন না কাজে যাবি খাওয়ার জুটবে না বলে দিচ্ছি’।
পরের দিন টিন হাতে বুড়ো আবার বেরোয়। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারে না। গলা পিচের রাস্তায় কাঠের পা বসে যায়। আবার ফুটপাথের শক্ত পাথরে পা ফেলতে গেলে কুঁচকিটা ব্যথায় টনটন করে ওঠে। তৃতীয় দিনের অপার্থিব ভোরে বুড়ো হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়ে। আর সেইসঙ্গে মুখ দিয়ে গালাগালির বন্যা ছোটে… ‘পাস্কুয়াল যদি না খেয়ে মরে…তার দায় কিন্তু তোদের’!
তাদের দুর্দশার দিন শুরু হয়। বাড়ির তিনজনই বিছানাবন্দী। গোটা দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযাগবিচ্ছিন্ন। এফ্রিন যন্ত্রণায় কাতরায়। কাশতে কাশতে গলায় রক্ত উঠে আসে এনরিকের। পেদ্রো কোরালের এদিক-ওদিক ছুটে নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে এনে মনিবের হাতে তুলে দেয়। ডন সান্তোস বিছনায় বসে কাঠের পায়ে হাত বোলায় আর নাতিদুটোকে শাপশাপান্ত করে যায়। কোরালের একদিকে কিছু সবজি হয়েছে। বুড়ো তাই দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দুপুরের খাবার সারে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একটা লেটুস পাতা বা গাজর নিয়ে নাতিদুটোকে লোভ দেখায়। হ্যাঁ, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না…ওদের লোভ দেখাতে হবে…পেটভর্তি খাবারের লোভ! তবে যদি ব্যাটারা বাগে আসে।
কথা বলার ক্ষমতা নেই এফ্রিনের। আর দাদুর ঘোলাটে চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে যায় এনরিকে। এ চোখের চাউনি সে চিনতে পারে না। এ যে মানুষ নয়, হায়নার দৃষ্টি! রাতে আবার চাঁদ ওঠে। পেদ্রোকে বুকে টেনের নিয়ে খুব আদর করে এনরিকে। আদর পেয়ে আনন্দে কুঁই কুঁই করে ওঠে পেদ্রো। রাত বাড়ে। খোঁয়াড় থেকে থেকে শোনা যায় জান্তব গর্জন। বুড়ো অস্থির হয়ে ওঠে। অসহায় হয়ে বুড়োও কাতরায়…যেন তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হচ্ছে। কাঠের পা-টা শক্ত করে বেঁধে মাঝে মাঝে কোরালের বাইরে বেরিয়ে যায়। চাঁদের আলোয় এনরিকে দেখে বুড়ো একবার খোঁয়াড়ে যাচ্ছে, একবার বাগানে। হাতে শক্ত মুঠি পাকিয়ে সব কিছু যেন ভেঙে চূরমার করে দিতে চাইছে। শেষমেশ ঘরে ঢুকে ছেলে দুটোর ওপর লাভা উগরে দিতে চায়…যেন পাস্কুয়ালের এই রাক্ষুসে খিদের জন্য তারাই দায়ী।
আজ শুক্লপক্ষের শেষ রাত। পাস্কুয়ালের বিকট গর্জন আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এনরিকে শুনেছে খিদে পেলে শূয়োররা নাকি উন্মাদ হয়ে যায়…ঠিক মানুষের মতো। দাদুর কানে সব যাচ্ছে, কিন্তু আজ আর তার কোন উচ্চবাচ্য নেই। গালাগালের বন্যাও নেই। বিছানায় শুয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। মনে মনে রাগ দানা বাঁধছে…তাও দাদু চুপ… একসময় প্রবল বহ্বাস্ফোটে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। দূরের পাহাড়গুলো রুপোলি আলোয় ভেসে যায়। বুড়ো তাকিয়ে থাকে হাঁ করে। নাতিদের দিকে তাকিয়ে ভেতরের রাগটা আবার দলা পাকিয়ে ওঠে। ‘ওঠ ওঠ বলছি শয়তানের দল’। এলোপাথাড়ি কিল, চড়, ঘুসির বন্যা বইয়ে দেয় বুড়ো… ‘ওঠ বলছি…শালা আলসে কুঁড়ের দল। এইভাবে আর কতদিন চলবে? উঠে দাঁড়া বলছি’।
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে এফ্রিন। তার যে উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই। দেওয়ালটা ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়ায় এনরিকে। দাদুর চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যায়। হাত-পা অবশ হয়ে আসে। দাদুর লাঠির বাড়ি নেমে আসে মাথায়। সে কোনও ব্যথা পায় না। ব্যথার বোধটাই তার আর নেই। শেষমেশ দুটো কথা বলে উঠতে পারে সে… ‘এফ্রিন থাক। ওর কোন দোষ নেই। আমি যাচ্ছি। হ্যাঁ হ্যাঁ আমি যাব’।
বুড়ো পিছিয়ে আসে। রাগে…উত্তেজনায় বুকটা তার হাপরের মতো ওঠানামা করে। নিজেকে সামলাতে একটু সময় লাগে বুড়োর… ‘এক্ষুনি যা না …দু টিন ভর্তি করে আনবি…না না চার টিন…
টিনগুলো নিয়ে এনরিকে ছুট লাগায়। ওষুধ নেই, পথ্য নেই। পেটে একদানা খাবার নেই। সোজা হয়ে সে দাঁড়াতে পারে না। খালি হোঁচট খেয়ে পড়ে। কোরালের দরজা খুলতে গিয়ে সে দেখে পেছনে পেদ্রো।
‘তুই আসিস না বাবা…বাড়িতে থাক। এফ্রিনের দেখভাল কর’।
এনরিকে রাস্তায় নামে। প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়। খিদেতে গা গুলিয়ে আসে। কিছু না পেয়ে খানিকটা ঘাস খেয়ে ফেলে। মাটি খাওয়ারও ইচ্ছে হয়। তার চোখের সামনে কুয়াশার ওড়নায় ঢালা এক মায়াবি জগত। নিজেকে পেঁজা তুলোর মতো হালকা মনে হচ্ছে। সে যেন মুক্ত বিহঙ্গ…শুধু ভেসেই চলেছে। আস্তাকুড়ে পৌঁছে দেখে দলে একটা নতুন শকুন। নিজের টিনগুলো ভর্তি করে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। ধর্মপ্রাণ মহিলা…রাতের ভবঘুরে…কাগজওয়ালা… ভোরের সব নিঃসৃত রস ছড়িয়ে পড়ছে শহরজুড়ে। ভোরের মায়াবি আলোর ভেতর দিয়ে জিনপরীর হাত ধরে হাঁটতে থাকে এনরিকে।
বাড়িতে ঢোকার মুখে দেখে দমবন্ধ করা এক গুমোট হাওয়া। থমকে দাঁড়ায় সে। মনে হয় এই দরজায় কাছে এসেই তার জগতটা শেষ হয়ে গেছে। ওপারে অন্য এক জগত…সেখানে শুধু পাঁক আর জান্তব গোঙানি। কোরাল জুড়ে এক ভূতুড়ে নৈঃশব্দ…এ যেন প্রবল এক ঝড়ের পূর্বাভাষ। কোন বিপর্যয়ের অশনি সংকেত। খোঁয়াড়ের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দাদু। দৃষ্টি তার আকাশের দিকে। দাদুকে দেখে মনে হয় যেন ঝুরি নামা প্রাচীন কোন বটগাছ। যুগ যুগ ধরে ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে…নিথর…নিশ্চল। এনরিকে এসে জোরে জোরে দাদুকে ডাকে। কোন সাড়া নেই।
‘এই যে টিন ভর্তি জিনিস এনেছি’।
দাদুর তাও কোন সাড়াই নেই। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কী হয়েছে টা কী? মনটা এবার কু ডাকে এনরিকের। ছুটে যায় ঘরের ভেতর। দাদাকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে এফ্রিন… ‘পেদ্রো…পেদ্রো…
‘হ্যাঁ, কী হয়েছে পেদ্রোর?’
‘পেদ্রো দাদুকে কামড়েছে…দাদু লাঠি নিয়ে নিয়ে তেড়ে গেছে…তারপর একবার শুধু কুকুরটার চিৎকার শুনেছি। আর কিছু জানি না আমি’।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এনরিকে… ‘পেদ্রো…পেদ্রো…গেলি কোথায়?’
পেদ্রোর কোনও সাড়া নেই। দাদু এখনও স্থির হয়ে মাটির দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মাথাটা গরম হয়ে যায় এনরিকের। বমি এসে যায়। লাফিয়ে গিয়ে সে দাদুর সামনে দাঁড়ায়… ‘পেদ্রো কোথায়? উত্তর দাও বলছি’!
তারপর এনরিকের চোখ যায় খোঁয়াড়ের দিকে। শুয়োরটা তার রাক্ষুসে খিদে নিয়ে ঘোঁতঘোঁত কী যেন গিলছে। খাবারটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে…শুধু কুকুরের লেজ আর পাগুলো পড়ে রয়েছে।
নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না এনরিকের। আহত পশুর মতো আর্তনাদ করে ওঠে… ‘না…এ কিছুতেই হতে পারে না। ঝাপসা চোখে সে শুধু দাদুর মুখটা খোঁজে। বুড়ো লোকটার মুখে কুলুপ। নাতির ঐ ভয়ংকর দৃষ্টি এড়াতে এখন মৌনতাই তার ভরসা। বুড়োর চারপাশে ভূতের মতো নাচতে শুরু করে এনরিকে। বুড়োর শার্ট ধরে ছিঁড়ে দেয়, একবার লাথি মারে। সে জবাব চায়…সোজা-সাপটা জবাব… ‘তুমি এটা কেন করলে? কেন? কেন?’
প্রথমটা বুড়ো চুপ করে থাকে। তারপর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতেই ছেলেটাকে ঠাসিয়ে মারে এক থাপ্পড়। মার খেয়ে গোত্তা খেয়ে মাটিতে পড়ে এনরিকে। ওদিকে দৈত্যের মতো বিশাল বপু নিয়ে পাস্কুয়ালের মহাভোজ তারিয়ে তারিয়ে দেখে বুড়ো। চুপিসাড়ে বুড়োর রক্ত মাখা লাঠিটা তুলে নেয় এনরিকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুড়োর ওপর… ‘পেছন ফেরো…ফেরো বলছি’।
বুড়ো পেছন ফিরে দেখে লাঠিটা দুলতে দুলতে সপাৎ করে তার পিঠে এসে পড়ল। ‘শিক্ষা হয়েছে? না আরো দিতে হবে’…চিল চিৎকার করে ওঠে এনরিকে। আবার এক থাপ্পড় মারতে গিয়েও থেমে যায়। এতক্ষণ মাথা ঠিক ছিল না তার। এ কী করছিল সে! লাঠিটা ফেলে দেয় সে। তার চোখে অনুশোচনা। কিন্তু বুড়ো খুব ভয় পেয়ে গেছে। ভয়ের চোটে এক পা, একপা করে পিছোতে, পিছোতে মাটিতে পা পিছলে খোঁয়াড়ের মধ্যে গিয়ে পড়ে।
ভয়ে পিছিয়ে আসে এনরিকে। কানখাড়া করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে। শুনতে না পেয়ে আরো দু-পা এগোয়। দাদু এখনও মাটিতে পড়ে রয়েছে। সারা গায়ে কাদা। কাঠের পা-টাও ভেঙে গেছে। মুখটা হাঁ করে অধীর হয়ে পাস্কুয়ালকে খুঁজে চলেছে। খোঁয়াড়ের এক কোণে দাঁড়িয়ে মাটিতে কী যেন একটা গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করছে পাস্কুয়াল…রক্তের গন্ধ।
চুপিচুপি যেমন এসেছিল, তেমনই পা টিপে টিপে ঘরে চলে যায় এনরিকে। দাদু তাকে বোধহয় দেখতে পায়নি! কিন্তু এনরিকে মনে কে যেন কাতর ভাবে তার নাম ধরে ডাকছে…এমন অসহায় ডাক সে আগে কখনও শোনেনি… ‘এনরিকে…দাদুভাই…ফিরে আয়…
এক ছুটে ঘরে গিয়ে ভাইকে ডেকে তোলে সে… ‘ভাই জলদি। বুড়োটা খোঁয়াড়ে পড়ে কাতরাচ্ছে। চল এই সুযোগে আমরা পালাই’।
‘কিন্তু দাদা কোথায় যাব?’
‘আস্তাকুড়ে। ঐ যেখানে শকুনগুলো ভিড় করে…কিছু না কিছু খাবার ওখানে মিলে যাবে’।
‘কিন্তু দাদা আমি যে উঠে দাঁড়াতেই পারছি না’।
দুহাত দিয়ে ভাইকে টেনে তুলে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে এনরিকে। এত শক্ত করে ভাইকে সে জড়িয়ে ধরেছে যে দুজনকে আর আলাদা করা যায় না। দু-ভাই একই সত্তায় বিলীন হয়ে গেছে। কোরালের দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে দু-ভাই দেখে অলৌকিক ভোরের কুয়াশা সরিয়ে দিনের কর্মব্যস্ততায় জেগে উঠেছে শহর। বিরাট এই শহরটা তাদের দুই ভাইকে দৈত্যের মতো হাঁ করে গিলে খেতে আসছে।
ওদিকে খোঁয়াড় থেকে শোনা যায় প্রবল ধ্বস্তাধ্বস্তির আওয়াজ।
বিঃদ্রঃ- পেরুতে বস্তির এক-কামরাওয়ালা ঘরকেই বলা হয় কোরাল।